শিরোনামঃ-

» গরিবের আইনজীবী হিসেবে পরিচিত অ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার!

প্রকাশিত: ১৯. অক্টোবর. ২০১৯ | শনিবার

সিলেট বাংলা নিউজ ডেস্কঃ

অ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার। সুপ্রিম কোর্টের প্রথিতযশা আইনজীবী। আইন পেশায় ৫৪ বছর পার করেছেন। ছিলেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সম্পাদক। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর এই সদস্য ‘গরিবের আইনজীবী’ হিসেবে খ্যাত।

কেমন আছেন?

শারীরিক অবস্থা পুরো ফিট, তা বলা যাবে না। তার পরও এই বয়সে (প্রায় ৮৩ বছর) বলতে পারেন ভালোই আছি। আমার জন্ম ১৯৩৮ সালের ১ জানুয়ারি, কুমিল্লার লাকসাম (বর্তমানে লালমাই) উপজেলার শানিচোঁ গ্রামে। বাবা আব্দুল আজিজ মজুমদার, মা জোলেখা বিবি। ছেলেবেলা কেটেছে গ্রামেই। ছয় বোনের পর আমার জন্ম বলে ছোটবেলায় ‘সাতখুন মাফ’ ছিল! কিছুটা দুরন্ত প্রকৃতির ছিলাম। পড়াশোনার বিষয়ে মা-বাবার তেমন চাপ ছিল না, যদিও আমার পরে আরো এক ভাই মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ মজুমদারের জন্ম হয়েছে। সে গ্রামেই থাকে। তবে ছয় বোনের কেউ এখন আর বেঁচে নেই। আমিও বার্ধক্যে পড়েছি। এ বয়সে এসে কিছুটা শারীরিক সমস্যা ধরা পড়েছে। সিঙ্গাপুরে যেতে হয় নিয়মিত চেকআপের জন্য। মূলত শরীরের দিকে নজর না দিয়ে আইনজীবী হিসেবে ব্যস্ততার মধ্যে জীবন কাটানোর কারণেই এসব সমস্যা। তার পরও নিয়মিত আমার কর্মস্থল সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছি।

লেখাপড়া কোথায় করেছেন?

শানিচোঁ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাস করে লাকসামের অতুল হাই স্কুলে ভর্তি হই। কিছুকাল সেখানে পড়ে গ্রামের পাশে, হরিচর হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (এসএসসি) পাস করি। এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ (এইচএসসি) ও বিএ পাস করি। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ও এলএলবি ডিগ্রি নিয়েছি। বাবার অনেক জমিজমা, সম্পদ ছিল। ব্যবসা করতেন। টাকা-পয়সার অভাব ছিল না। তবে তাঁর একটাই চাওয়া ছিল, আমি যেন লেখাপড়া করি। কারণ তিনি ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন। পাশের বাড়ির একজন সে সময় এমএ পাস করেন। বাবা সে কথাটাই বেশি বেশি বলতেন। এ ছাড়া আমার এক চাচাতো ভাইও সে সময় বিএসসি পাস করেছিলেন। এসব কারণে বাবা সব সময় চাইতেন আমি যেন উচ্চশিক্ষিত হই, যদিও তখন আমাকে সেভাবে গাইড করার কেউ ছিল না। নিজে যা পারতাম, সেভাবেই পড়েছি। পরিতাপের বিষয়, আইএ ভর্তি হওয়ার পর ঠিকমতো লেখাপড়া না করায় প্রথমবার ফেল করি। এ কারণে সবার মন খারাপ। পরেরবার মন দিয়ে পড়ে পাস করেছি। বিএ পাসের পর বাবা বললেন এমএ পড়তে হবে। তাঁর ইচ্ছাতেই ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম।

সরকারি চাকরি করা হলো না বাবার কারণেই?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে মাস্টার্স করছি—এমন সময় এক বন্ধু বলল, ‘বিএ পাস করেছ। ঢাকায় থাকো। বাবার কাছ থেকে আর কত টাকা নেবে? অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল অব বাংলাদেশে (এজিবি) চাকরি করো।’ বন্ধুর পরামর্শে এজিবিতে আবেদন করি। চাকরিও হলো। ১৯৬৩ সালের কথা। চাকরিতে যোগ দিলাম। এক দিন অফিস করলাম। ঠিক পরদিন ভোরবেলা বাবা বাসায় হাজির। মুখ বেশ ভার। কী হয়েছে? কয়েকবার জিজ্ঞেস করলাম। জবাব দিলেন না। অনেকক্ষণ পর বললেন, ‘তোমাকে ঢাকায় পাঠিয়েছি ল পড়ার জন্য। চাকরি করার জন্য নয়। আমার কি টাকার অভাব? স্যুটকেস গোছাও। বাড়ি চলে যাও।’ চাকরি করা আর হলো না।

জীবনের টার্নিং পয়েন্ট?

এমএ পাস করার পর ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। আইনের ডিগ্রির পর অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের চেম্বারে জুনিয়র হিসেবে যোগ দিই। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তাঁর সঙ্গে কিছুকাল কাজ করার পর ১৯৬৬ সালে ঢাকা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছি। বাবার পরামর্শ শুনে আইনে আসা—এটিই আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।

আইনজীবীদের নেতা হলেন কখন?

অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম ছিলেন নামকরা সিভিল লইয়ার (আইনজীবী)। তাঁর চেম্বারে থেকেই ধীরে ধীরে বড় হওয়া। এরপর ১৯৭২ সালে আরেক বিখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার শওকত আলীর চেম্বারে যোগ দিই। তাঁর চেম্বারে আসার পর আইন পেশায় আমার বিকাশ ঘটতে থাকে। বড় বড় মামলা পেতে থাকি। মূলত তখনই আমার ক্যারিয়ার দাঁড়িয়ে যায়। আর্থিকভাবে কিছুটা স্বাবলম্বী হওয়ার পর একপর্যায়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পদে নির্বাচন করে বিজয়ী হই। ছাত্রজীবনে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে এবং বিভিন্ন সময় জাতীয় রাজনীতিবিদদের সংস্পর্শে আসার কারণেই ভেতরে ভেতরে নেতৃত্ব দেওয়ার একটা মানসিকতা সৃষ্টি হয়। যেহেতু আইনজীবীদের সঙ্গে সারাক্ষণ থাকি, তাই মনে মনে ঠিক করেছিলাম সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে নির্বাচন করব। সমিতির নির্বাচনে প্রথমবারই সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। এরপর সহসম্পাদকসহ বিভিন্ন পদে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছি। এরই ধারাবাহিকতায় দুইবার (১৯৮৬-৮৭ ও ১৯৮৭-৮৮) সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছি। আমার আগে টানা দুইবার এ পদে কেউ নির্বাচিত হননি। এই সমিতির সভাপতি পদেও একবার (২০০১-০২) নির্বাচিত হয়েছি। এরপর বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে নির্বাচন করে সাতবার সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। ভাইস চেয়ারম্যানও হয়েছি। কয়েকবার নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছি। সর্বশেষ নির্বাচনে এত ভোট পেয়েছি, তা সমসাময়িককালে কেউ পায়নি। তার পরও আমি ভাইস চেয়ারম্যান হতে পারিনি। যিনি চতুর্থ হয়েছেন তাঁকেই ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়েছে। থাক সে কথা!

জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নেননি…

আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জাতীয় রাজনীতি করার ইচ্ছা হলো। জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়নের স্থান। সেখানে যে আইন হবে, সে অনুযায়ী দেশ চলবে। এ কারণে আগে আইনজীবীদের মধ্য থেকেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতেন বেশি। সব রাজনৈতিক দলও আইনজীবীদের মধ্য থেকেই বেশি প্রার্থী দিত। কিন্তু এখন ঠিক উল্টো ঘটছে। এ কারণে মহান জাতীয় সংসদেও মাঝেমধ্যে খুব খারাপ আইন পাস করা হচ্ছে। যেমন— সম্প্রতি সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তার বিষয়ে যে আইন করা হয়েছে, তা খুবই খারাপ একটি আইন। দুর্নীতি করলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যাবে না, কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে—এটা কেমন আইন? এই আইনের মাধ্যমে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। এজাতীয় আইন করার মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উত্সাহিত করা হচ্ছে। যা হোক, জাতীয় রাজনীতি করার চেষ্টা করেছিলাম। এলাকায় কিছু কাজও করি। এরই মধ্যে আমাদের নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে একটি জায়গায় মনোনয়ন দিলেন। তবে জায়গাটির নাম বলব না। নির্বাচনী এলাকায় আর সুপ্রিম কোর্টে দৌড়াদৌড়ি করছি। তখনো মনোনয়নপত্র দাখিল হয়নি। একদিন এক নেতা এসে বললেন, ‘আমার গাড়িতে ওঠেন। কিছু কথাবার্তা বলি।’ তাঁর কথামতো গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি চলছে। ওই নেতা বললেন, ‘রাজনীতি করা তো একটু জটিল। আপনি রাজনীতি করতে চাইছেন। কিন্তু এতে সমস্যা আছে।’ বললাম, কী সমস্যা? তিনি বললেন, ‘আমার গাড়ির পেছনে একটি বস্তা আছে।’ বললাম, কিসের বস্তা? তিনি বললেন, ‘খুলে দেখুন।’ আমি বস্তাটি খুলে দেখি, টাকা আর টাকা। এত টাকা দেখে আঁতকে উঠলাম। বললাম, এত টাকা কেন? তিনি বললেন, ‘রাজনীতি করতে হলে এভাবে বস্তা বস্তা টাকা লাগবে।’ এটা দেখে ও শুনে মনে হলো, এত টাকা দিয়ে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। কারণ বৈধভাবে এভাবে বস্তা বস্তা টাকা উপার্জন করা সম্ভব নয়। আমি আইনজীবী মানুষ। দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা উপার্জন করতে পারব না। সেই থেকে সক্রিয় জাতীয় রাজনীতির চিন্তা বাদ দিয়েছি।

দুস্থ আইনজীবীদের আর্থিক সহযোগিতায় পদক্ষেপ নিয়েছেন…

বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর দেখলাম, সারা দেশ থেকে অসংখ্য আইনজীবী সাহায্যের আবেদন করেছেন কিন্তু এখানে সাহায্য দেওয়ার তেমন ফান্ড নেই। একটি বেনেভোলেন্ট ফান্ড আছে। যে পরিমাণ আইনজীবী সাহায্য চান, তাতে সেই ফান্ড থেকে তাঁদের সাহায্য দেওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে নিজেই ‘আব্দুল বাসেত মজুমদার ট্রাস্ট’ গঠন করি। আইনজীবীদের সাহায্য করার জন্যই এই ট্রাস্ট। এর মাধ্যমে প্রতিটিবার অ্যাসোসিয়েশনে দুই লাখ করে টাকা দিই। এটা আমার ব্যক্তিগত উপার্জন থেকে দেওয়া। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত কমিটি ট্রাস্ট পরিচালনা করে। ওই টাকার লভ্যাংশ থেকেই সাহায্য দেওয়া হয়।

আইনজীবীদের শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন…

বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান থাকাকালে আইনজীবীদের জন্য এডুকেশন প্রগ্রামের ওপর জোর দিয়েছি। বার কাউন্সিলের এডুকেশন কমিটিকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছি। কারণ আইনজীবীদের মধ্যে কেউ কেউ ঠিকমতো মামলার আরজি লিখতেও পারেন না। ঠিকমতো শুনানি করতে পারেন না। আইনজীবীদের ‘লার্নেট’ বলা হয়। তাঁদের জ্ঞানী হিসেবেই ধরা হয়। কিন্তু বাস্তব জীবনে মামলা পরিচালনা করতে এসে সেই জ্ঞানের অভাব দেখা দেয়। এ কারণেই নতুন আইনজীবীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। একজন ভালো আইনজীবী হতে হলে জ্ঞান অর্জনের বিকল্প নেই। প্রতিদিন লেখাপড়া করতে হবে। বিশ্বের কোন দেশে কী রায় হচ্ছে, তা জানতে হবে। কোন মামলায় কোন প্রেক্ষাপটে কী রায় দিচ্ছেন আদালত—তা জানতে এবং নিজের মামলায় প্রয়োগ করতে হবে। এ জন্য লেখাপড়া ছাড়া উন্নতির সুযোগ নেই।

পেশাগত জীবনের শুরুতে কঠিন সংগ্রাম করেছেন…

বাবা আর্থিকভাবে সচ্ছল হলেও আমি আইনজীবী হওয়ার পর তাঁর কাছ থেকে টাকা নিতে দ্বিধা লাগত। একপর্যায়ে সেটি বন্ধ করে দিলাম। তখন আমার বাসা ঢাকার গেণ্ডারিয়ায়। সিনিয়রের তাঁতীবাজার চেম্বার থেকে সেখানে যেতাম প্রতিদিন। অনেক সময় পকেটে টাকা থাকত না। রিকশায় যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না। হেঁটে যেতাম। এরই মধ্যে ১৯৬৫ সালে বিয়ে করেছি। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বিয়ের পর অনেক দিন স্ত্রীকে তার বাবার বাড়ি থাকতে হয়েছে। ১৯৭৬ সালে তাকে ঢাকার বাসায় আনি। আমি চেম্বারে গেলে গেণ্ডারিয়ার বাসায় স্ত্রী একা থাকত। টাকা ছিল না বলে অনেক রাত না খেয়েও কাটিয়েছি। এভাবে কষ্ট করে, হিসাব করে চলেছি। তবে হাল ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করিনি কখনো। অবশেষে পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে।

আপনার ব্যক্তিগত জীবন?

ব্যক্তিগত জীবনে আমি অত্যন্ত সুখী মানুষ। চার সন্তানের জনক। সিনিয়র অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের স্ত্রী আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তাঁর মাধ্যমেই তাঁর বোনের মেয়ে রওশন জাহান মেহেরুন্নেসাকে বিয়ে করেছি। কিছুটা নিজের পছন্দ, কিছুটা পারিবারিকভাবে বিয়ে। তাকে বিয়ে করে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। কারণ আমি টাকা-পয়সা খরচ করার ব্যাপারে খুবই বিশৃঙ্খল। পুরো সংসার গুছিয়ে রেখেছে আমার স্ত্রী। আমাদের বড় ছেলে গোলাম মহিউদ্দিন আবদুল কাদের ব্যবসা করে। ছোট ছেলে অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমদ রাজা। আমার চেম্বার সে-ই সামলাচ্ছে। দুই মেয়ের মধ্যে ফাতেমা আক্তার লুনা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। সর্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিউজিকে পড়াশোনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছে। ছোট মেয়ে খাদিজা আক্তার ঝুমা উত্তরা মেডিক্যাল কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। সে আমার প্রতিষ্ঠিত আব্দুল বাসেত মজুমদার ট্রাস্ট হাসপাতালে প্রতি মঙ্গলবার রোগী দেখে।

জীবনকে কিভাবে দেখেছেন?

ওকালতি শুরুর সময়টি বড়ই কঠিন। তেমন আয় থাকে না। সব মিলিয়ে বড় কঠিন সময় পার করেছি। আর্থিক অনটন ও দারিদ্র্যের সঙ্গে কাটালাম অনেক দিন। তবে জীবনে পালাবার পথ খুঁজিনি। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত বড় আইনজীবীরই এটা কমন ইতিহাস। তবে যাঁদের বাবা বিচারক বা আইনজীবী, তাঁদের কথা হয়তো আলাদা। আইনজীবী হিসেবে শুরুর দিনগুলোতে আমার সিনিয়র আব্দুস সালাম আমাকে মাঝেমধ্যে দুই-পাঁচ টাকা দিতেন। হয়তো এই পেশায় আমাকে উত্সাহ দেওয়ার জন্যই এমনটি করতেন। তাঁর কাছ থেকে অনেক শিখেছি। তিনি ডিকটেশন দিতেন। আর আমি সেই অনুযায়ী মামলা প্রস্তুত করে দিতাম। এভাবে সিভিল, ক্রিমিনাল, রিটসহ কয়েক হাজার ডিকটেশন নিয়েছি। এই ডিকটেশন নেওয়ার পর সিনিয়র কিভাবে সেটি উপস্থাপন করেন, তা আদালতে বসে দেখেছি। ব্যারিস্টার শওকত আলীর চেম্বারে যোগ দেওয়ার পর সেখানেও সিনিয়রের ডিকটেশন নিয়েছি। এভাবেই তাঁদের কাছ থেকে শিখেছি আর তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। ডিকটেশন নিয়ে ফাইল প্রস্তুত করে দিতে কষ্ট হয়। সেই কষ্টের ভয়ে পালিয়ে থাকিনি।

তরুণ আইনজীবীদের কোন বিষয়টি খারাপ লাগে?

আজকাল যা দেখি তাতে খুব হতাশা লাগে, দুঃখ হয়। যেসব তরুণ মেধাবী আইনজীবী এই পেশায় আসছেন, তাঁদের অনেকেই কোনো সিনিয়রের চেম্বারে জুনিয়রশিপ করতে চান না। করলেও অল্প কিছুদিন পরই নিজেই চেম্বার দিয়ে বসেন। এভাবে হয়তো তাত্ক্ষণিকভাবে কিছু আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন কিন্তু এসব আইনজীবীর ভবিষ্যৎ আশঙ্কার মধ্যে থেকে যাচ্ছে। তাঁদের মামলার ফাইল দেখলে আদালতের বিচারকরা রাগারাগি করেন। ভুলে ভরা নথি। কিভাবে মামলা উপস্থাপন করে আদালতকে নিজের পক্ষে আনা যায়, তার কোনো বালাই নেই। অন্যদিকে যাঁরাই ভালো সিনিয়রের চেম্বারে মনোযোগ দিয়ে জুনিয়রশিপ করেছেন, তাঁরা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে জুনিয়রশিপের বিকল্প নেই। কিন্তু তরুণরা আজ কম্পিউটারকে সিনিয়র বানিয়ে নিয়েছেন। তাঁদের বলব, ‘সিনিয়রের কাছ থেকে কাজ শিখে নাও। এখনই বড় হইও না। বড় একদিন হওয়া যাবে। তার জন্য সাধনা করো। সাফল্য এক দিনে ধরা দেয় না। বড় হওয়ার শর্টকাট কোনো পথ নেই। এ পথ বন্ধুর। ক্লায়েন্টের আস্থা অর্জন করো। নিজের ভেতরে দায়িত্ববোধ তৈরি করো।’ আইন পেশা বেতনভুক্ত কোনো চাকরি নয়। মানুষকে সেবা দেওয়ার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে হবে—এটাই এ পেশার মূলমন্ত্র। এই গুণ অর্জন করতে হবে। তাই কিছু মামলা ফ্রি করতে হবে। কিছু মামলা টাকা নিয়ে করতে হবে। বিচারপ্রার্থীদের আস্থা যদি অর্জন করা যায়, তাহলে টাকার অভাব হবে না।

মামলায় হারার পর কেমন অনুভূতি হয়?

একজন আইনজীবীকে মনে রাখতে হবে, মামলায় হার-জিত দুটিই আছে। তবে ক্লায়েন্ট যেন বুঝতে পারেন, আমি তাঁর জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। মামলা হারার পেছনে আমার কোনো দুর্বলতা বা চেষ্টার ঘাটতি ছিল না। মামলার মেরিটের অভাবেই তিনি হেরেছেন, এটা যেন ক্লায়েন্ট বুঝতে পারেন। আমি কখনো বলিনি, আপনার মামলা জিতিয়ে দেব। বলেছি, চেষ্টা করব। তবে মামলায় হারার পর আমারও খারাপ লাগে। লোকটা এত টাকা খরচ করল! মনে রাখতে হবে, আইন পেশা একটি সেবামূলক পেশা। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আদালতকে সহযোগিতা করাই আইনজীবীর দায়িত্ব।

হতাশার কোনো জায়গা আছে?

যখন কুমিল্লা কলেজে ভর্তি হই, সেখানে কিছু বাজে ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল। লেখাপড়ার জন্য বাবার দেওয়া টাকা আমি বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে খরচ করতাম। খেলাধুলা করে বেড়াতাম। লেখাপড়া ঠিকমতো করতাম না। এ কারণেই আইএ ফেল করেছিলাম। ওই ঘটনা এখনো আমাকে হতাশ করে। আফসোস হয়, কেন খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মিশেছিলাম?

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে মূল্যায়ন?

দেশের মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সর্বশেষ আশ্রয়স্থল সুপ্রিম কোর্ট। ন্যায়বিচার, সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার, আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগের জন্য বার ও বেঞ্চের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকতে হয়। পারস্পরিক সহযোগিতা ও আস্থার মধ্য দিয়েই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পরিবেশ গড়ে ওঠে। অতীতে ছিলও তাই। এ দেশের সিনিয়র আইনজীবী ও মাননীয় বিচারকদের গুণগত মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। বিদেশেও আমাদের সুপ্রিম কোর্ট সম্পর্কে একটা উজ্জ্বল দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। এ ক্ষেত্রে আইনজীবী সমিতির ভূমিকাও ছিল গৌরবান্বিত। সেই ভূমিকা আজ অনেকটাই ম্লান। এ জন্য দায়ী দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব। আইনজীবীদের রাজনৈতিক মতামত থাকবে, দলীয় আনুগত্যও থাকতে পারে; কিন্তু আদালতকে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করলে আইনজীবীদের পেশাগত মর্যাদা লোপ পায় বলে আমি মনে করি। কারো কারো মধ্যে রাজনীতি করে আইনজীবী হওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। আমি উকিল হয়ে রাজনীতিবিদ হতে চাই না। এটা বিচারাঙ্গনের অবক্ষয়ের একটি কারণও বটে। একটি উদাহরণ দিই। একজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হয়েছেন। তাঁকে কোনো দিন সুপ্রিম কোর্টে দেখিনি। তাঁর বিষয়ে জানতে চাইলে একজন বললেন, রাজনৈতিক পরিচয়েই এই পদ পেয়েছেন। আরো একজনের উদাহরণ দিয়ে বললেন, আগে হাফশার্ট পরে কোর্টে আসতেন। সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হয়ে বিরাট বিত্তশালী হয়েছেন। তাঁদের দেখাদেখি অন্যরাও আসতে চান। আসছেনও। আগে তো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন নিয়ে অনেক কথা ও আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। কিন্তু এগুলো প্রকৃতপক্ষে এখনো অধরা। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সব সরকারের আমলেই দলীয়করণের অভিযোগ রয়েছে। এটিই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রধান অন্তরায়। আমরা সব সময়ই বিচারক নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনার পরিবর্তে সততা, মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় আনার কথা বলে আসছি। এ বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য এ ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। আরেকটি কথা, সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের অভিভাবক। এই সুপ্রিম কোর্টের ওপর যদি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তো সব শেষ। সম্প্রতি তিনজন বিচারপতি নিয়ে যা শুনলাম, তা আমাদের হতাশ করেছে। বেশি হতাশ করেছে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের পদ্ধতি। আমার সুস্পষ্ট কথা হলো, কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ ওঠে, তবে তা অতি গোপনে অনুসন্ধান করতে হবে। অনুসন্ধানে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁকে ডেকে বলতে হবে, ‘এখন কী করবেন?’ কিন্তু সেই পথে না গিয়ে অনুসন্ধানের আগেই মিডিয়ায় সব বলে দেওয়া হলো। এতে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এমনটি করা যাবে না। কারণ সুপ্রিম কোর্টের ওপর আস্থা নষ্ট হলে সবই (রাষ্ট্র, আইনের শাসন) শেষ হয়ে যাবে।

বিচার বিভাগে আপনার আদর্শ?

আমার আদর্শ আমার সিনিয়র আব্দুস সালাম সাহেব। তিনি মক্কেলের কাছ থেকে কত টাকা নিলেন, একটি খাতায় হিসাব রাখতেন। সেই খাতায় তিনি নিজে স্বাক্ষর করতেন, মক্কেলেরও স্বাক্ষর রাখতেন। চুক্তি অনুযায়ী বেশি টাকা নেওয়া হলে মামলা শেষে ফেরত দিতেন। এখন অনেক আইনজীবীর মধ্যেই এটি দেখি না। তাঁর এ গুণটি আমি ধরে রেখেছি। আমিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মক্কেলের সঙ্গে চুক্তি করি। সব টাকার হিসাব রাখি। মামলা শেষে যদি দেখি চুক্তির চেয়ে বেশি নিয়েছি, বাকি টাকা ফেরত দিই। এভাবে চলার কারণেই আজ আমার এ অবস্থা। ৩০ বছর আগে যে মক্কেল এসেছিলেন, তিনি এখনো আমার রয়ে গেছেন।

আইনজীবী হয়ে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কারণ?

আমি একটি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলাম। এখন অনেকটা সুস্থ। তখন দেখেছি, দেশে কত মানুষ চিকিত্সা না পেয়ে মারা যাচ্ছে। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। তাই ঠিক করলাম একটি হাসপাতাল করব। কয়েক বছর আগে কুমিল্লার নিজ এলাকায় ‘আব্দুল বাসেত মজুমদার ট্রাস্ট হাসপাতাল’ গড়ে তুলেছি। এর আগে থেকেই আমার ডাক্তার মেয়েকে নিয়ে এলাকায় যেতাম। সে এলাকার গরিব মানুষকে চিকিত্সাসেবা দিত। এরই ধারাবাহিকতায় হাসপাতাল করেছি। সেখানেও আমার মেয়ে প্রতি মঙ্গলবার বিনা পয়সায় রোগী দেখে। একটি মসজিদও করেছি। এটি করেছি বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী।

আপনাকে অনেকে ‘গরিবের আইনজীবী’ বলে…

অনেক মামলা টাকা ছাড়াই লড়েছি। অনেক গরিব মানুষ আসে, যারা বাধ্য হয়ে মামলায় জড়িয়েছে। তাদের অবস্থা দেখে আমার মন কাঁদে। এ কারণে তাদের কাছ থেকে ফি নিতে পারি না। যে যা দেয় তাই রেখে দিই। না দিলেও কিছু বলি না। আমার ওকালতি জীবনে ২০ হাজারের বেশি মামলা ফ্রি লড়েছি। আমার এই অবস্থা দেখে সাংবাদিকরা আমাকে ‘গরিবের আইনজীবী’ হিসেবে অভিহিত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। এর পর থেকে আরো মানুষ আসছে। তারা বলে, ‘পত্রিকায় দেখেছি, আপনি গরিবের আইনজীবী।’ এটা বলার পর আর কিছু বলতে পারি না। নিজেকে ‘গরিবের আইনজীবী’ ভাবতে ভালোই লাগে।

বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজন আছে?

আইয়ুব খানের সময় থেকেই বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ শুরু হয়েছে। তাঁর সময়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে আদালত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আর এইচ এম এরশাদ উপজেলা পর্যায়ে আদালত নিলেন। সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে হাইকোর্টের ছয়টি সার্কিট বেঞ্চ করা হলো। এই সার্কিট বেঞ্চের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়ে সেটি বাতিল করেছেন। এই বিকেন্দ্রীকরণের ফল কিন্তু আমাদের জন্য সুখকর নয়। এর ফলে মামলা-মোকদ্দমা বেড়ে গিয়েছিল। এর ঠিক উল্টো দিকও আছে। আমাদের হাইকোর্ট ঢাকায় হওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের অসুবিধা হচ্ছে। গ্রামাঞ্চল থেকে আসতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করতে হলে বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। আমাদের সংবিধানেও সে ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এই বিকেন্দ্রীকরণের আগে দেশের মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে আইনজীবী-বিচারকদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। বিচারপ্রার্থী যাঁরা, তাঁদের মানসিকতা হলো যেকোনোভাবেই হোক মামলায় জিততে হবে। তাঁরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা মাথায় রাখেন না। এ কারণে আপাতত বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজন নেই। তবে একসময় এটা করতে হবে। এর আগে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের মানুষকে প্রস্তুত করতে হবে।

মামলার জট কমাতে আপনার পরামর্শ?

সারা দেশে এখন ৩৮ লাখ মামলা চলছে। এই মামলা কমাতে হলে সরকার, আইনজীবী ও বিচারক—সবাইকে কাজ করতে হবে। দেখুন, একটি রাজনৈতিক প্রগ্রাম হলে সেটিকে কেন্দ্র করে শত শত মামলা হয়। এটা বন্ধ করতে হবে। আর এক শ্রেণির মানুষ আছে, যারা মামলা জিইয়ে রাখে। আইনজীবীদের পক্ষ থেকে তাদের বোঝাতে হবে, এভাবে মামলা করা যাবে না। আর বিচারকদেরও দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, উত্স বা উত্পত্তি বন্ধ না হলে মামলা কমবে না।

বিশেষ সাক্ষাৎকারে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি এম বদি-উজ-জামান। ছবি তুলেছেন কাকলী প্রধান

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে ১১৬৬ বার

Share Button

Callender

April 2024
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930