শিরোনামঃ-

» কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ও শব্দময় পৃথিবী

প্রকাশিত: ২০. জুলাই. ২০১৬ | বুধবার

সিলেট বাংলা নিউজ ডেস্কঃ বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে ১৭ কোটি মানুষের বসবাস এবং যাদের মধ্যে রয়েছে একটি অংশ বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, যারা বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী হিসেবে সমাজে পরিচিত। শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা তার একটি।
বাংলাদেশের শতকরা ৯.৬ ভাগ মানুষ প্রতিবন্ধী ধরনের বধিরতায় ভোগে। আবার দেশের শতকরা ১.২ ভাগ মানুষ যারা মারাত্মক বা সম্পূর্ণ বধিরতায় একেবারেই শুনতে পায় না, তারা কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপনের সম্ভাব্য প্রার্থী বা রোগী হয়ে থাকে। আর এই কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বা বায়োনিক ইয়ার হলো শ্রবণ সহায়ক অত্যাধুনিক এমন একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস যা মারাত্মক বা সম্পূর্ণ বধির ব্যক্তিকে শব্দ শুনতে সহায়তা করে।
ইমপ্লান্ট চালুর পর বধির ব্যক্তির কাছে তখন পৃথিবীটা শব্দময় হয়ে ওঠে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের দুটি অংশ, একটি অংশ কানের বাইরে থাকে, যে অংশে থাকে মাইক্রোফোন, স্পিচ প্রসেসর ও ট্রান্সমিটার এবং আরেকটি অংশ কানের ভেতরে থাকে, যে অংশে থাকে রিসিভারস্টিমুলেটর এবং ইলেকট্রোড। অপারেশনের মাধ্যমে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট অন্তঃ কর্ণের কক্লিয়াতে স্থাপন করা হয়।
একটি টিমওয়ার্কের মাধ্যমে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সেবা প্রদান করা হয়। এই টিমের মধ্যে থাকে ইএনটি সার্জন, অডিওলজিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট বা অডিটরিভারবাল থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট ও সমাজকর্মী। বিভিন্ন রোগে অন্তঃকর্ণের ক্ষতিগ্রস্ত কক্লিয়ার জন্য কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে শিশু বা ব্যক্তির শ্রবণ বধিরতার মাত্রা দেখার জন্য প্রথমে কিছু অডিওলজিক্যাল ও রেডিওলজিক্যাল টেস্ট করা হয়।
এই টেস্টের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির। এর পর রোগীর সাইকোলজিক্যাল ও জেনারেল এ্যানেসথেসিয়ার উপযুক্ততার জন্য কিছু টেস্ট সম্পন্ন করা হয়। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির ২-৩ সপ্তাহ পর অডিওলজিস্ট সুইচ অন এবং ম্যাপিং করে যথার্থ শব্দ শোনার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। তারপর ইমপ্লান্ট গ্রহীতাকে শব্দ শোনা ও ভাষা শেখানো হয় বা হ্যাবিলিটেশন করে স্পিচ থেরাপিস্ট।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ডেভলপমেন্ট অব কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট গ্রোগ্রাম ইন বিএসএমএমইউ’ এর কর্মসূচি পরিচালক ও ইমপ্লান্ট সার্জন অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদারের নেতৃত্বে একটি টিম ২০১০ সাল থেকে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি ব্যবস্থাপনা করে আসছে।

দেশের দরিদ্র ও সাধারণ শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে প্রতি পর্যায় তিনবছর মেয়াদী মোট দু’টি পর্যায়ে ছয় বছর যাবত্ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ডেভলপমেন্ট অব কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট গ্রোগ্রাম ইন বিএসএমএমইউ’ নামক কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে।

এই কর্মসূচির আওতায় জুন ২০১৬ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক, কান ও গলা বিভাগে মোট ১১০ জন শ্রবণ প্রতিবন্ধীকে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইস প্রদান ও সার্জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯০টি কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইস সরকারি খরচে দেওয়া হয়েছে।

সরকারি সহায়তার বাইরে বাকি ২০টি ডিভাইস সামর্থ্যবান রোগীরা নিজ খরচে ক্রয় করেছে। সর্বশেষ ৩০ জুন সরকারি খরচে আরো ৪১ জন শিশুকে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বরাদ্দ দিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শহীদ ডা. মিলন হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে এসব শিশুর বাবা ও মায়েদের হাতে এই বরাদ্দপত্র তুলে দেন।

অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই যন্ত্রের এক একটির দাম ১০ লাখ টাকারও বেশি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় দরিদ্র ও সাধারণ পরিবারের শিশুদের ঈদের উপহার হিসেবে এই যন্ত্র দেওয়া হয়। ‘ডেভলপমেন্ট অব কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট গ্রোগ্রাম ইন বিএসএমএমইউ’ কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল হাসানাত জোয়ারদার বলেন, এই যন্ত্র বিদেশে গিয়ে স্থাপনে আনুমানিক খরচ পড়ে দেশ ভেদে প্রায় ৩০-৫০ লাখ টাকা।

যা বাংলাদেশের সাধারণ দরিদ্র, স্বল্প আয়ের এমনকি মধ্যবিত্তদেরও সামর্থ্যের বাইরে। সেখানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইস প্রদানে বর্তমান সরকারের এই আর্থিক সহযোগিতা শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি অনন্য ও যুগান্তকারী ঘটনা এবং এটি সরকারের একটি মহত্ কর্মসূচি।

তাঁর মতে, জন্মগত বধিরদের ক্ষেত্রে ২ থেকে ৩ বছর বয়সে ইমপ্লান্ট করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। অন্যদিকে জন্মের পরে ভাষা আয়ত্ত করা ব্যক্তিরা জীবনের যে কোন সময়ে কোনো কারণে সম্পূর্ণ বধির হয়ে গেলে তাদেরকে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি করলে তারাও কানে শুনতে সক্ষম হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্বচ্ছ বরাদ্দ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই যন্ত্রটি দেওয়া হয়। প্রথমে বরাদ্দের আবেদন চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য, প্রার্থীর বয়স, অভিভাবকের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ভাষা প্রশিক্ষণ নেওয়ার আগ্রহসহ অন্যান্য নীতিমালার আলোকে প্রার্থী নির্বাচন করা হয়।

জাদুকরী বিষয় এই যে, একেবারেই কানে শুনতে না পাওয়া শিশু বা বয়স্ক ব্যক্তি যারা উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন হিয়ারিং এইড ব্যবহার করেও কানে শুনতে পায় না, তারা কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট এর মাধ্যমে শ্রবণের জগতে প্রবেশ করতে এবং নিয়মিত ভাষা শিক্ষার প্রশিক্ষণ নিয়ে কথা বলতে পারে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট গ্রহীতারা স্বাভাবিক জীবন আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপনের পর অনেক শিশু মূল ধারার স্কুলে যেতে পারছে। এমন শিশুর অভিভাবকগণ নতুন আলোয় জীবনের স্বপ্ন রচনা করছেন মানসিক ও সামাজিক স্বস্তির মাঝে অবস্থান করে।

কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জন অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদার বলেন, আমাদের সমাজে অনেক বিত্তবান ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান আছে যারা মানুষকে সহায়তা দিতে ইচ্ছুক কিন্তু অনেক সময় সঠিক জায়গা খুঁজে পায় না।

আমি তাদেরকে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট প্রার্থীদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে অনুরোধ করব। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশ সরকারের মহত্ উদ্যোগের পাশাপাশি সমাজের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি শব্দময় পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে।

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে ৫৩৩ বার

Share Button

Callender

May 2024
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031