শিরোনামঃ-

» যন্ত্রের পরীক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে ৩৫ শতাংশ বাস–ট্রাক; চলাচলের অনুপযোগী লক্ষাধিক গাড়ি

প্রকাশিত: ০৯. মার্চ. ২০১৭ | বৃহস্পতিবার

ডেস্ক সংবাদঃ নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পরও চলাচলের অনুপযোগী (ফিটনেসবিহীন) যানবাহন চলছেই। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে নিবন্ধন পাওয়া যানবাহনের মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার চলাচলের অনুপযোগী। এসব যানবাহনের ৩৫ শতাংশই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে নেওয়া সনদের পরীক্ষায় টিকছে না। এই হিসাব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিটনেস সনদ না থাকার অর্থ হচ্ছে যানবাহনের ত্রুটি থাকার আশঙ্কা আছে। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন সড়ক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

বিআরটিএর হিসাবে, বর্তমানে সংস্থাটির ঢাকার তিনটি কার্যালয় ও চট্টগ্রাম থেকে নিবন্ধন নেওয়া যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ। এর প্রায় অর্ধেক মোটরসাইকেল। মোটরযান আইনে মোটরসাইকেলের জন্য ফিটনেস সনদ নেওয়ার নিয়ম নেই। বাকি সব যানের জন্য প্রতিবছর এই সনদ নিতে হয়। সারা দেশে যানবাহন রয়েছে ২৯ লাখ ৪৯ হাজার।

সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। জানতে চাইলে সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সাংবাদিককে বলেন, পরিসংখ্যান যা-ই বলুক না কেন, খালি চোখে দেখলেই মনে হয় ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে চলাচলকারী গণপরিবহনের ৯৫ শতাংশ অনুপযুক্ত। ফিটনেস দেওয়ার পদ্ধতিতে গলদ আছে। সড়কে আইনের প্রয়োগও কম। গলদ সারতে সব স্থানে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু করতে হবে। আর আইনের প্রয়োগ জোরদার করতে হবে।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, ফিটনেসবিহীন যানের বড় অংশ চলছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর এবং এর আশপাশে। আর কিছু চলছে দূরের পথে। সম্প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালত জোরদার করার পর ফিটনেস সনদ নিতে ভিড় পড়েছে সংস্থাটির বিভিন্ন কার্যালয়ে। সারা দেশে বিআরটিএর ৫৭টি কার্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে গত অক্টোবর থেকে মিরপুর কার্যালয়ে সীমিতভাবে যন্ত্রের সাহায্যে ফিটনেস পরীক্ষা শুরু হয়েছে। বিআরটিএর বাকি কার্যালয়গুলোতে সংস্থাটির মোটরযান পরিদর্শকেরা চোখে দেখে ফিটনেস পরীক্ষা নেন।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহে যন্ত্রের সাহায্যে ২০৭টি বাস-ট্রাকের ফিটনেস পরীক্ষা নেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৩৫টি যান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। বাকি ৭২টি অর্থাৎ ৩৫ শতাংশ ব্যর্থ হয়। মিরপুরে গত অক্টোবর থেকে প্রায় ১ হাজার ৪০০ বাস-ট্রাকের যন্ত্রে পরীক্ষা নেওয়া হয়। প্রথম দিকে অর্ধেকই পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়। মিরপুর কার্যালয়ে প্রতিদিন অন্তত ৪০০ যানবাহন ফিটনেস নিতে আসে। কিন্তু যন্ত্র দিয়ে দিনে ৪০টির বেশি যান পরীক্ষা করা যায় না।

মোটরযান আইনে, মেয়াদোত্তীর্ণ না হলে ফিটনেস সনদ পরীক্ষায় ব্যর্থ যানবাহনকে ত্রুটি সারিয়ে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক মাসুদ আলম সাংবাদিককে বলেন, সক্ষমতা কম বলে এখন শুধু বাস-ট্রাক ও বাণিজ্যিক যানের ফিটনেস পরীক্ষা যন্ত্রের সাহায্যে নেওয়া হয়। এই ব্যবস্থায় যানে ত্রুটি পেলে যন্ত্রই বলে দেয়, এটি পরীক্ষায় ব্যর্থ। কারও কিছু করার নেই।

ভেহিকেল ইন্সপেকশন সেন্টার (ভিআইসি) নামের এই যন্ত্র ১৯৯৯ সালে প্রথম চালু করা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ পাঁচটি বিভাগীয় কার্যালয়ে এসব যন্ত্র বসানোর পরপরই বিকল হয়ে যায়। এবার দক্ষিণ কোরিয়ার অনুদানে প্রায় ২২ কোটি টাকায় মিরপুরে পুনরায় যন্ত্র বসানো হয়েছে।

বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে লক্ষাধিক যানবাহনের ফিটনেস সনদ নেই যেমন সত্য, তেমনি যেসব যানের সনদ আছে, যন্ত্রে পরীক্ষা হলে সেগুলোর একটা বড় অংশই চলাচলের উপযুক্ততা হারাবে।

মোটরযান আইন বলছে, যানবাহনের ফিটনেস সনদ পাওয়ার মূল শর্ত হচ্ছে কারিগরি ও বাহ্যিকভাবে চলাচলের উপযোগী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে যানবাহনের ৬০টির মতো কারিগরি ও বাহ্যিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। এসব বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যানের ইঞ্জিনের পুরো কার্যকারিতা, আকৃতি ও নিবন্ধনের সময় উল্লেখ করা ওজন ঠিক আছে কি না। দেখতে হবে কালো ধোঁয়া বের হয় কি না এবং ব্রেক, লাইট ও বাহ্যিক অবয়ব ঠিক আছে কি না। এসব বিষয় নিশ্চিত হলেই ফিটনেস সনদ দেওয়ার নিয়ম।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, মালিক যদি নিশ্চিত হন যে তাঁর মালিকানাধীন যানবাহনটি এসব শর্ত পূরণ করতে পারবে না, তখন আর ফিটনেস সনদ নিতে আসেন না। সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিককে বলেন, ফিটনেস সনদ হালনাগাদ থাকলেই যে যানটি চলার উপযোগী, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ, ঢাকা ও এর আশপাশে চলা বাস-ট্রাকসহ বাণিজ্যিক যানের অর্ধেকই বাইরে থেকে দেখে মনে হবে সনদ পাওয়ার উপযোগী নয়। কিন্তু এমন অনেক যানের হালনাগাদ সনদ আছে। গত বছর এমন একটি লক্কড়-ঝক্কড় বাস আটক করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরে কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখা যায়, এর ফিটনেস সনদ হালনাগাদ। ভ্রাম্যমাণ আদালতের হাকিম বিষয়টি বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে অবহিত করলে ওই বাসের সনদ দেওয়া মোটরযান পরিদর্শককে বরখাস্ত করা হয়।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলার পেছনে কতগুলো কারণ আছে। বিআরটিএর একশ্রেণির কর্মকর্তা ঘুষ নিয়ে অনেক সময় যানবাহন না দেখেই সনদ দিয়ে দেন। পুলিশ সড়কে কঠোর অবস্থান নিলে ফিটনেসবিহীন যান চলাচল কমে যাবে।

ছুটির দিন বাদে বর্তমানে প্রতিদিন বিআরটিএর চারটি ভ্রাম্যমাণ আদালত বসে। এসব আদালতের একজন নির্বাহী হাকিম নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিককে বলেন, চলাচলের অনুপযোগী ও বৈধ কাগজপত্র ছাড়া যেসব যানবাহন চলে, সেগুলোকে তাঁরা জব্দ করে ডাম্পিংয়ে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু অনেক যানবাহন পরে আবার পুলিশের কাছ থেকে মালিকেরা ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। ফলে একই বাস পুনরায় রাস্তায় নামছে।

জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব এম এ এন সিদ্দিক সাংবাদিককে বলেন, ফিটনেসবিহীন যান যাতে পরীক্ষা দিতে আসে, সে জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত জোরদার করা হয়েছে। আর যেনতেনভাবে যাতে লক্কড়-ঝক্কড় যান সনদ না পায়, সে জন্য বিভিন্ন কার্যালয়ে আরও পাঁচটি যন্ত্র বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে জেলাপর্যায়েও যন্ত্র বসানো হবে।

কোন এলাকায় কত ফিটনেসবিহীন যান

বিআরটিএ সূত্র বলছে, ঢাকায় বিআরটিএর তিনটি কার্যালয় রয়েছে। এগুলো হচ্ছে মিরপুর, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া। এসব কার্যালয় থেকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে প্রায় ১১ লাখ যানবাহনকে। এর মধ্যে ৯২ হাজার ২৪৮টি যানের হালনাগাদ ফিটনেস সনদ নেই। এ ছাড়া চট্টগ্রামে রয়েছে প্রায় সোয়া ২ লাখ যানবাহন। এর মধ্যে ফিটনেসবিহীন যানবাহন সাড়ে ১৬ হাজার।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের একটা বড় অংশ বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান। কোন কোন যানবাহন নিবন্ধনের পর আর কোনদিন ফিটনেস সনদ নেয়নি। ৫/৭ বছর ধরে ফিটনেস সনদ নেওয়া হয় না এমন যানবাহনও রয়েছে। ব্যক্তিগত কিছু গাড়ির মালিকেরাও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফিটনেস সনদ নেন না; যা ফিটনেসবিহীন যানবাহনের তালিকায় চলে যায়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক সামছুল হক বলেন, যানবাহনে দিকনির্দেশক ইন্ডিকেটর লাইট দিয়ে এক চালক অন্য চালকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সে অনুযায়ী চালক ব্রেক কষে কিংবা হুইল ঘোরান। এর একটা ত্রুটিপূর্ণ হলেই দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। সামান্য একটা ওয়েফার (গ্লাস মোছার সরঞ্জাম) না থাকার কারণেও গাড়ি বৃষ্টি বা কুয়াশায় দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে। টায়ার ফেটে গিয়ে দুর্ঘটনা হয়। আকৃতি পরিবর্তন দুর্ঘটনার বড় কারণ। এর সবগুলোই ফিটনেসের সময় নিশ্চিত করার কথা। ফিটনেস না থাকা মানে দুর্ঘটনার ঝুঁকি, ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির আশঙ্কা।

নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে এই অধ্যাপক বলেন, কয়েক বছর আগে যমুনা সেতুর কাছে দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৮ জনের প্রাণ যায়। তদন্তে দেখা গেছে, একটি বাসের ১৬ জন, আরেকটির দুজন মারা যায়। এর পেছনে মূল কারণ ছিল বেশি প্রাণহানির শিকার হওয়া বাসটির আসন যথাযথভাবে বসানো ছিল না। দুর্ঘটনায় সব আসন উঠে গিয়ে এক স্থানে জমে যায়। অন্যটির আসন ঠিক ছিল।

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে ৫৭০ বার

Share Button

Callender

May 2024
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031