শিরোনামঃ-

» সিলেট জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন এর ১০ম সম্মেলনে বক্তারা

প্রকাশিত: ২৪. ফেব্রুয়ারি. ২০২১ | বুধবার

দাবি আদায়ের আন্দোলনকে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে পরিণত করার মধ্যেই শ্রমিক-কৃষক-জনগণের মুক্তি নিহিত

স্টাফ রিপোর্টারঃ

সিলেট জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি: নং চট্ট: ১৯৩৩) এর ১০ম সম্মেলন ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বুধবার বিকেল ৪টায় শহিদ সোলেমান হলে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সিলেটের হোটেল-রেস্টরেন্ট শ্রমিকদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার এক আমেজ সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন শ্রমিক অঞ্চলে থেকে হোটেল-রেস্টরেন্ট শ্রমিকরা মিছিল ক্বীন ব্রিজ পয়েন্ট জমায়েত হয়। পরবর্তীতে বিকেল ৩.৩০টায় বিভিন্ন ফেস্টুন-ব্যানার দ্বারা সুসজ্জিত লাল পতাকা র‌্যালি ক্বীন ব্রিজ পয়েন্ট থেকে শুরু হয়ে সিলেট মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে শহিদ সোলেমান হলের সম্মেলনস্থলে গিয়ে শেষ হয়। সিলেট জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন এর সভাপতি মো. ছাদেক মিয়ার সভাপতিত্বে সম্মেলন উদ্বোধন করেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সিলেট জেলা শাখার সভাপতি এডভোকেট কুমার চন্দ্র রায়। এসময় উপস্থিত সবাই সম্মিলিতভাবে দাঁড়িয়ে শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংগীত ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ গান।

সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ হোটেল রেষ্টুরেন্ট সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশন রেজি: নং- বি-২০৩৭ এর সাংগঠনিক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ সিলেট জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. সুরুজ আলী, সুনামগঞ্জ জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন এর সভাপতি মো. লিলু মিয়া, মৌলভীবাজার জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন এর সভাপতি মো. মোস্তফা কামাল, সিলেট জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন এর উপদেষ্টা মো. আনু মিয়া।

প্রধান অতিথি তাঁর বক্তব্যে বলেন, আজ এমন এক সময় সিলেট জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন এর ১০ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন পৃথিবী এক গভীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রিক সংকটে জর্জরিত। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস কোটি কোটি মানুষকে আক্রান্ত করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রতিদিন নভেল করোনা ভাইরাসে মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রচলিত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার অসারতা সামনে চলে আসছে। উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলায় দীর্ঘদিনের ঘোষিত লকডাউনে পৃথিবীর সকল দেশের অর্থনৈতিক জীবনসহ সামগ্রিক সামাজিক কর্মকাণ্ডকে স্থবির করে দেয়। সঙ্গত কারণেই নভেল করোনা ভাইরাসজনিত বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলায় প্রয়োজন ছিল বৈশ্বিক সমন্বিত উদ্যোগ। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও তার বিশ্ব সংস্থা এবং দেশে দেশে দালাল সরকারগুলো তা না করে সংকটের প্রকৃত ঘটনাকে সামনে না এনে নানা রূপের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সংকটের বোঝা পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণি, নিপীড়িত জাতি ও জনগণের উপর চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে দেখা দেওয়া নভেল করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রথম দিকে বাংলাদেশে ছিল না। বিদেশ থেকে আগত প্রবাসীদের দেশে ফিরে আসার মধ্যদিয়ে দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার ঘটে। বিমানবন্দরে পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাছাড়া ব্যাপকভাবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ইতালি ও অন্যান্য দেশ থেকে আগত প্রবাসীদেরকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আনুষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে না রেখে মফস্বলে গ্রামের বাড়িতে ঘরবন্দী (ঐড়সব ছঁধৎবহঃরহব) থাকার জন্য বলে দেওয়া হয়। যার মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পথ প্রশস্ত হয়। অথচ সে সময় দেশে আসা প্রবাসীদের যথাযথ পরীক্ষা নিরীক্ষা ও সরকারি তত্ত্ববধানে কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধ করা সম্ভব হতো। শুরু থেকেই আমাদের দেশের সরকার করোনা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতির কথা জানালেও বাস্তবে তার প্রতিফলন ছিল না; ‘করোনা থেকে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী’ সরকারের মন্ত্রীদের এমন আস্ফালনমূলক বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ক্ষমতাসীন সরকার করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাম্রাজ্যবাদ ও তার বিশ্বসংস্থার বৈশ্বিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনগণকে সচেতন না করে লকডাউনের নামে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, প্রচার মাধ্যমকে স্বপক্ষে ব্যবহারের মাধ্যমে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে জনগণকে দায়ী করে সরকার ও শাসক শ্রেণির দুর্নীতি, লুটপাট, দমন-পীড়ন ও ব্যর্থতাকে ঢাকার অপচেষ্টা চালায়।

অতিথিবৃন্দ বলেন, বিদ্যমান শোষণমূলক বিশ্বব্যস্থায় শ্রমিক-কৃষক-জনগণের উপার্জিত অর্থ ও সম্পদ জনগণের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা) পূরণের লক্ষ্যে ব্যয় না হয়ে মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজিপতির হাতে কেন্দ্রীভুত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের শোষণ-লুন্ঠন এবং দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি দেশ ও সমাজকে অন্ধকার যুগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনকে, রাজনীতির নামে গোটা দেশ ও সমাজকে কলঙ্কিত করছে। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাজনীতি বিমুখ করার কাজে এরা নিয়োজিত। যুব সমাজের শক্তিকে হীনবল করতে মাদক, অস্ত্রবাজী, নারী নিগ্রহ এ সকল পথ বেছে নিয়েছে। নারী ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন, নারী ও শিশু পাচার, পর্ণোগ্রাফী ও কালোবাজারি, মাদক ব্যবসা ইত্যাদি গণবিরোধী অসামাজিক কার্যকলাপ বাংলাদেশেও ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে আজ ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আজ প্রগতিশীল শক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে। এই দেশের কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-যুবসমাজ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে জীবন দিয়েছে, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের কর্মকান্ডকে বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেয়নি। নতুন করে বর্তমানেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সকল প্রগতিশীল শক্তিকে সম্মিলিতভাবে হায়েনাদের বিরুদ্ধে, রক্তখেকো ড্রাকুলাদের বিরুদ্ধে, তাদের সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকে রুখে দাঁড়াতেই হবে। ঐক্যবদ্ধ প্রগতিশীল শক্তি আমাদের দেশে অতীতেও এমন অনেক স্বৈরাচার, স্বৈরাচারের দোসরদের পতন ঘটিয়েছে। বর্তমান দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকদেরকে দাবি আদায়ের আন্দোলনকে অগ্রসর করে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে নিয়ে যেতে হবে এবং শোষণমূলক সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্যেই শ্রমিক-কৃষক-জনগণের মুক্তি নিহিত।

বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শ্রমিক সেক্টর হচ্ছে হোটেল রেস্টুরেন্ট সুইটমিট শ্রমিক সেক্টর। গ্রাম্য জোতদার মহাজনের শোষণে জমি-জমা হারিয়ে জীবিকার তাগিদে শহরে এসে হোটেল সেক্টরে অমানুষিক পরিশ্রম করে দুঃখ কষ্টের জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছি। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যে শ্রমিকরা হোটেল রেস্টুরেন্টে সুন্দর ও মজাদার রকমারি খাবার তৈরি ও পরিবেশন করে তাদের পরিবারেই সবদিন দুবেলা ডাল-ভাত জুটে না। চাল, ডাল, তেল, চিনি, লবনসহ প্রত্যেকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির কারণে জনজীবন আজকে দূর্বিসহ হয়ে পড়ছে। মালিকের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও মালিক আমাদেরকে নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র দেয়নি; নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা ও মানসম্মত কাজের পরিবেশের ব্যবস্থা নেই, এমনকি থাকা খাওয়ার নিশ্চয়তাও নেই। দেশে চরম বেকারত্বের কারণে যতসামান্য বেতনে আমাদেরক কাজ করতে বাধ্য করা হয়। সরকার গত জাতীয় কমিশনে সরকারি কর্মচারী, মন্ত্রী, এমপিসহ সর্বস্তরের সুবিধাভোগিদের বেতন ভাতা দিগুণ করেছে। কিন্তু হোটেলসহ বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত শ্রমিক ও শ্রমজীবীরা সরকারের এ বেতন কমিশন থেকে বঞ্চিত। দীর্ঘদিন আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের ফলে অনেকটা বাধ্য হয়ে সরকার হোটেল সেক্টরে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে এবং একটি গেজেট প্রকাশ করে। হোটেল সেক্টরের জন্য যে গেজেট ঘোষণা করা হয়েছ বর্তমান বাজারে তা দিয়ে এক সপ্তাহ চলাই কষ্টসাধ্য। নামমাত্র বেতন নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করলেও মালিকরা তা বাস্তবায়ন করছে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরও গেজেট বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। শ্রমিকরা উদ্যোগী হয়ে গেজেট বাস্তবায়নের কথা বললে মালিক ও তার ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা শ্রমিকদেরকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে এবং বিভিন্ন হুমকী দেয়। অনেক সময় কোনো ধরনের আইনি পাওনা না দিয়েই বিনা নোটিশে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেয়।এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সংগঠন-সংগ্রামকে অগ্রসর করার বিকল্প নেই।

সিলেট জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন এর সহ-সাধারণ সম্পাদক ও ১০ম জেলা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম-আহবায়ক আনছার আলীর পরিচালনায় সম্মেলনের শুরুতে বিভিন্ন শ্রমিকনেতা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও করোনাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুবরণকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন ও শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিলেট জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন এর সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ইমান আলী, জিন্দাবাজার আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মো. আলমাছ মিয়া, জাতীয় ছাত্রদল শাহজালাল বিশ^দ্যিালয় শাখার সভাপতি দীনবন্ধু দাস সৌরভ প্রমুখ।

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে ২৩৩ বার

Share Button

Callender

April 2024
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930