শিরোনামঃ-

» আল আজাদ; প্রগতিশীল সাংবাদিকতার ৪ যুগ

প্রকাশিত: ৩০. আগস্ট. ২০২০ | রবিবার

মিহিরকান্তি চৌধুরীঃ

প্রগতিশীল ধারার সিনিয়র সাংবাদিক, সামাজিক-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংগঠক ও বিশিষ্ট লেখক আল আজাদের সাংবাদিকতার সময়কাল ৪ দশক পেরিয়ে ৪ যুগের কাছাকাছি। সঠিক পথে, ব্যাকরণশুদ্ধ সাংবাদিকতার চর্চায় ও প্রয়োগে তার রয়েছে অনেক অর্জন যা অবশ্য হাল আমলের বৈষয়িক ব্যাকরণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ৪ যুগের দ্বারপ্রান্তে তাকে শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন জানাই।

তাঁর সাথে আমার পরিচিতিরও ৩ যুগ পেরিয়েছে (১৯৮৪- ২০২০)। এই দীর্ঘ সময়কালে তার মতো সজ্জন ব্যক্তি কমই পেয়েছি।

দৈনিক সংবাদ থেকে শুরু করে প্রথম শ্রেণির জাতীয় বিভিন্ন দৈনিকে কর্মরত ছিলেন, কখনও বা সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে, কখনও বা ব্যুরো প্রধান হিসেবে, প্রথম যুগে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে। প্রযুক্তির যুগে চ্যানেল আই, মাছরাঙা টেলিভিশন ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের সিলেটের বিভাগীয় প্রতিনিধি ছিলেন। এসকল পদে অত্যন্ত উচুঁমানের পেশাদারিত্ব দিয়ে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেন।

সৎ, আদর্শশবান ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে সমাজে নামডাক আছে। ভরসার জায়গা। কারণ আছে। মূল শক্ত। খেলাঘরের সাথে ছোটবেলা থেকেই সম্পৃক্ত, সম্পৃক্ত উদীচীর সাথে। নানা পদ-পদবীতেও ছিলেন। তার চেয়ে বড়ো কথা, পদ-পদবীর বাইরে কাজের কাজী ছিলেন। মননের কাঠামো নির্মাণে ও ধাচ গঠনে বাম হাতের একটা খেল তো ছিলই। সে সাথে তার পারিবারিক শিক্ষাদীক্ষা, প্রগতিশীল ভাবনা বিরাট ভূমিকা রেখেছে। তাছাড়া, তার বাড়ির এলাকা সুনামগঞ্জের দিরাই প্রগতিশীল আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক ভাবনার এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ব্যক্তি বিকাশের এক অনন্য আতুড়ঘর। সেগুলোর অবদানও অনস্বীকার্য।

আশির দশকের প্রথম দিকে যখন আজাদ ভাইয়ের সাথে দেখা ও পরিচয়, প্রায় একই সময়ে পরিচিত হই আরও কয়েকজন বিশিষ্ট সাংবাদিকের সঙ্গে যাঁদের মধ্যে রয়েছেন মাহবুবুর রহমান (যুগভেরীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক), আজিজ আহমেদ সেলিম, মি. তাপস দাশপুরকায়স্থ, জনাব মহিউদ্দিন শীরু, সালাম মসরুরসহ আরও কয়েকজন। কয়েক বছর পরে ঘনিষ্ঠতা হয় ইকবাল সিদ্দিকী, লিয়াকত শাহ ফরিদি, ইকরামুল কবির, ইখতিয়ারউদ্দিন সহ আরও কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিকের সাথে। তবারক হোসেইনের সাথে আগে থেকেই পরিচিত ছিলাম। আমাদের বাড়ি একই এলাকায়।

১৯৮০ সালে আমার বাবার মৃত্যুর পর আমাদের অত্যন্ত শুভাকাঙ্ক্ষী জনাব তবারক হোসেইন (পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট) আমাকে শাহবাজপুর হাইস্কুলে শিক্ষক পদে চাকুরি দিয়ে যারপরনাই উপকার করেছিলেন, বাঁচিয়েছিলেন একটি পরিবারকে নিশ্চিত আর্থিক বিপর্যয় থেকে। তারা সবাই আমাকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, করেছেন সহযোগিতা। ১৯৮৭ সালে আমার পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অ্যাকাডেমি অব টু আরস্ থেকে পুষ্প প্রদর্শনীর আয়োজন করি।

অনেক সাড়া জাগানো এই পুষ্প প্রদর্শনীর আয়োজনে সিলেটের পুরো সংবাদ মাধ্যম ও উল্লিখিত শ্রদ্ধাভাজন সাংবাদিক বিশেষ করে আল আজাদ, তবারক হোসেইন,  মাহবুবুর রহমান, মহিউদ্দিন শীরু ও সালাম মসরুর অসামান্য সহযোগিতা করেন।

প্রদর্শনীর ৩/৪ দিন আগে থেকে গুরুত্বের সাথে সংবাদ প্রকাশ এবং পুষ্প প্রদর্শনীর পরের দিন সব কটি পত্রিকায় সচিত্র লিড নিউজ। অনুমানের বাইরে। আজাদ ভাই, শীরু ভাই ও সালাম ভাইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় দুইতিন দিন পর জাতীয় দৈনিক’ দৈনিক বাংলা’ ও ’বাংলার বাণী’-তে এবং সপ্তাহখানেক পরে লন্ডনের ’সুরমা’ পত্রিকায় সচিত্র ফিচার। অভাবনীয়।

২০২০ সালে ১৯৮৭ সালের সেই বিষয়ের অনুভূতি ও সার্বিক পরিপ্রেক্ষিত ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সিলেটের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আবু তাহের।

সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট সমাজসেবী অ্যাডভোকেট আব্দুল হক। সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও সংবাদ মাধ্যমের অনেকের উপস্থিতি, অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় একটি সফল অনুষ্ঠান ছিল সেটি।

অন্যান্য সাংবাদিকের মধ্যে বোরহানউদ্দিন খান ও জাহিরুল হক চৌধুরীর সাথে ভিন্ন ধরণের সম্পর্ক ছিল। তাদের ছেলেমেয়েরা আমার ছাত্র ছিল। ফয়জুর রহমান, আব্দুস সাত্তার সহ আরও অনেকের সাথেও ঘনিষ্ঠতা হয়। ঘনিষ্ঠতা হয় মুকতাবিস ইন নূর, আহমেদ নূর ও আবদুল মালিক জাকার সাথে।

নতুন প্রজন্মের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকের মধ্যে রয়েছেন মি. অপূর্ব শর্মা, দিদার আলম চৌধুরী ও মি. দেবাশীষ দেবু। মি. অপূর্ব শর্মা ও মি. দেবাশীষ দেবু বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন।

এখানেই শেষ নয়। ১৯৮৭ থেকে ২০০০ পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মিডিয়ার নিরন্তর সহযোগিতা। ২০০১ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ “দ্য ওরিয়েন্টাল সান’ এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সিলেটের সংবাদ মাধ্যম বিশেষ করে আজাদ ভাই, সেলিম ভাই (আজিজ আহমেদ সেলিম), শীরু ভাই, সালাম ভাই আবারো আন্তরিকভাবে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ উপায়ে সহযোগিতা করেন।

অনুষ্ঠানের পরের দিন সকল পত্রিকায় চার কলাম সচিত্র লিড নিউজ। আমি তাঁদের বলিওনি। তাঁরা কন্টেন্ট বুঝে নৈর্বক্তিকভাবে কাজ করতেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা নেই।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন, মহান জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার  হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ও বিশেষ অতিথি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, বিশিষ্ট লোকতত্ত্ব-গবেষক প্রফেসর মাযহারুল ইসলাম।

সভাপতি ছিলেন প্রফেসর বাহাউদ্দিন জাকারিয়া। বড় ক্যানভাসের অনুষ্ঠান, বড় প্রচার। সব কিছুর মূলে আজাদ ভাই ও অন্যান্য যাদের কথা ইতোমধ্যে বলেছি।  হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর যোগাযোগে অগ্রজপ্রতিম বন্ধু বাংলাদেশ ওভারসিজ সেন্টারের নির্বাহী কর্মকর্তা সামসুল আলম ও যুবলীগ নেতা নজরুল ইসলাম। তাঁদের সহযোগিতার কথাও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। প্রফেসর মাযহারুল ইসলাম স্যারের সাথে আমি নিজেই যোগাযোগ করি।

অতিথি ব্যক্তিত্ববৃন্দ যারপরনাই দয়াপরবশ হয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তখন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের বলয় রাজনীতির যুগ। স্থানীয় জেলা প্রশাসন সামাদবান্ধব বলে পরিচিত।

এই অনুষ্ঠানে প্রশাসনের কেউ আসবে না। তবে আজাদ ভাই, সেলিম ভাই ও শীরু ভাই বুদ্ধি দিলেন সবাইকে দাওয়াত দিতে। দাওয়াত দিলাম। জেলা প্রশাসক আব্দুস সোবহান সিকদারসহ কেউই সঙ্গত কারণে আসেননি। স্পিকার মহোদয়ের মিডিয়া টিমের এক ক্যামেরাম্যান আমার মিডিয়া আনুকূল্য পেতে তার জন্য পরোক্ষভাবে বৈষয়িক আনুকূল্য চান। আমি সাড়া দিইনি, কিছু বুঝে, কিছু না বুঝে। আজাদ ভাই সায় দিলেন, ”ভালো করেছেন। প্রচার করলে করবে, না করলে নাই।’ শেষ পর্যন্ত পরের দিন রাতের খবরে প্রচার করেছে। তখন ভিডিও ক্লিপ এখনকার মতো ডিজিটাল ট্রান্সফার হতো না। সরেজমিন জমা দিতে হতো। আজাদ ভাইয়ের শক্ত নৈতিক অবস্থান আমাকে অনুপ্রাণিত করে। এর পর ২০০৩ সালে আমার পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অ্যাকাডেমি অব টু আরস্ থেকে আয়োজিত গুণিজন সংবর্ধনা ও প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারা আমার উদ্যোগগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। কেন্দ্রীয় ভূমিকায় আজাদ ভাই। আজাদ ভাই, সেলিম ভাই ২০১২ সালে টেগোর সেন্টারের উদ্বোধনে উপস্থিত থেকেছেন, আগে পরে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মানিত আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী প্রধান অতিথি ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব খান মোহাম্মদ বিলালের ভূমিকার কথা ভুলবার নয়। সংশ্লিষ্ট সকলকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। পুরো সংবাদ মাধ্যমের অনেককে চিনতাম, যাদের চিনতাম না, আজাদ ভাই পরিচয় করিয়ে দিতেন। তবে দর্শন বিষয়ে বয়লা, নিবয়লা কিছু বাছতেন সঙ্গত কারণেই। সহজ অথচ কার্যকরী পরিচয়, ’মিহিরদা!’ আমি তার পৃষ্ঠপোষকতা, সৌজন্য, সহযোগিতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার জন্য আজীবন কৃতজ্ঞ। আরও কত সহযোগিতা, সহানুভূতি। যেকোনও মানসম্পন্ন অনুষ্ঠানে বা সমাবেশে আমার অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করতেন, আমাকে রাখতেন, এখনও করেন, রাখেন।

আজাদ ভাই প্রগতিশীল ভাবধারার একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব। সকল গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথের লড়াকু সৈনিক।

আজাদ ভাই মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার গড়ে তুলেছেন অসীম সাহসিকতায়। বইয়ের সংগ্রহ, পাঠাগারের ভাড়া, স্টাফ বেতন, রক্ষনাবেক্ষণের নৈমিত্তিক খরচ সবই নিজ হাতে, নিজ পকেট থেকে কুলোচ্ছেন। এতো বড় উদ্যোগের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার।

সংবাদমাধ্যমে তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি সিআইপি এর মতো মিডিয়া হাউস চালিয়েছেন দীর্ঘদিন। “অনুশীলন” এর মতো অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠনের গোড়াপত্তনে, প্রচারে, প্রসারে, বিকাশে আজাদ ভাইয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তার বেশ কিছু মৌলিক লেখা ও সম্পাদনা রয়েছে। ‘স্মৃতিভাস্বর উত্তরপূর্ব রণাঙ্গন’ এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনা এবং পুরো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এই বইটির গ্রন্থালোচনা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

অতি সম্প্রতি এই অঞ্চলের বিষ্ময়কর প্রতিভা মুহাম্মদ আব্দুল হাই হাছন পছন্দ এর অবদান নিয়ে তার প্রণীত গ্রন্থ, “ভাষাসংগ্রামী আবদুল হাই” প্রকাশিত হয়েছে। করোনাদুর্যোগকে উপেক্ষা করে বইটি উপহার দিলেন তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। মুহাম্মদ আবদুল হাই হাছন পছন্দ-কে নিয়ে লেখা বইখানা দারুণ আনন্দ দিল। একজন বাঙালি হিসেবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, মহান ভাষা আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলনে মুহাম্মদ আবদুল হাই অবিষ্মরনীয় অবদান রাখেন। বইটির বহুল প্রচার কামনা করি। আজাদ ভাইকে অনেক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।

আজাদ ভাইয়ের অনেক সৃজনশীল কর্মপরিকল্পনা রয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়িত হওয়ার পথ সুগম হোক।

তিনি ভালো থাকুন স্ত্রী, পুত্র-কন্যা সহ। তাঁকে আবারও শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানাই।

লেখক, গবেষক, অনুবাদক।

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে ৪৯০ বার

Share Button

Callender

April 2024
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930