» বাংলা বানান রীতির সংস্কার প্রসঙ্গে কিছু প্রস্তাব

প্রকাশিত: ১৫. ফেব্রুয়ারি. ২০২০ | শনিবার

মো. আব্দুল মালিকঃ

মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি প্রত্যেক মানুষের শ্রদ্ধা ও গৌরবের বস্তু। আমাদের মায়ের ইতিহাস যাই-ই হউক আমাদের মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির ইতিহাস একদিকে খুবই বেদনাদায়ক, অন্য দিকে গৌরবের। আমাদের হাজার বছরের পুরাতন বাংলাভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ আবি®কৃত হয়েছে নেপালের রাজ দরবারের পুঁথিশালা থেকে। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে মহা মহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এটি আবিষ্কার করেন। এতে অনুমিত হয় তৎকালে বাংলা ভাষিরা মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন এবং কেউ কেউ লুকিয়ে তাদের সাহিত্যকর্ম সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর বাংলা নামক এই ব-দ্বীপ বহুবার বিদেশিদের দ্বারা শাসিত, ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। বাংলা ভাষার উপর আক্রমন এসেছে সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি, উর্দুওয়ালাদের থেকে। বাঙালি জাতির ইতিহাস আড়াই/তিন হাজার বছরের পুরাতন হলেও এই সুদীর্ঘ সময়ে বাঙালিরা কখনো স্বাধীন বা শাসক ছিলেন না।

আমরা ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট একবার এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আরেকবার স্বাধীনতা লাভ করি। ১৯৭১ সালে আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে শাসকের মর্যাদা লাভ করি। প্রতিবেশি রাষ্ট্র মায়ানমার থেকে যেভাবে রোহিঙ্গারা নির্যাতিত নিপীড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, ঠিক একই ভাবে ১৯৭১ সালে এ অঞ্চলের প্রায় এক কোটি বাঙালি প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত, দু’লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা কারো দানে পাওয়া নয়।

১৯৫২ সালে এ অঞ্চলের মানুষ পাকিস্তানের ৭% মানুষের ভাষা উর্দূর সাথে ৫৬% মানুষের ভাষা বাংলাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদার দাবীতে জীবন দিয়েছেন। ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর অঞ্চলের ১১ জন বাঙালি। বিশ্বের ইতিহাসে আর কোন জাতিকে তার মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য এভাবে জীবন দিতে হয়নি।

মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির জন্য আমাদের এই আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। পাকিস্তানে আজো উর্দু রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পায় নি। পক্ষান্তরে বাংলা আজ বিশে^র তিনটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তান আমলে নিষিদ্ধ বাঙ্গালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা আজ তিনটি দেশের জাতীয় সংগীত। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় ভাষণ দান করে বিশে^র দরবারে বাংলা ভাষাকে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাঙালির ২১ ফেব্র“য়ারিকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সম্মিলিত অনলাইন বিশ^কোষ উইকিপিডিয়া ২০০৪ সাল থেকে বাংলা সংস্করণ চালু করে। বিশে^র সর্বাধিক জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক ২০০৯ সাল থেকে বাংলা ভাষা যুক্ত করে। বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখা সহ সকল বিশে^র মাতৃভাষার গবেষণা, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও সমন্বয় সাধনের জন্য ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। ৫ ডিসেম্বর ২০০৮ জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদ ২১ ফেব্রæয়ারিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভূক্তির প্রস্তাব করেন, যা জাতিসংঘের সক্রিয় বিবেচনাধীন আছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ, টাঙ্গুয়ার হাওর ইত্যাদি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অর্ন্তভূক্ত হয়েছে। ৩০ অক্টোবর ২০১৭ ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ ১৯৭১ এর ভাষণকে ২৪৭ তম বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সহ আর্ন্তজাতিক ও আঞ্চলিক অনেক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরুষ্কার লাভ করে বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে প্রথম বিশ্বের দরবারে পরিচিত করেন। তারই ধারাবাহিকতায় আরো ৩ জন বাঙালি অন্য বিষয়ে নোবেল পুরুষ্কারে ভূষিত হয়েছেন।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ি বিশ্বের প্রায় ২৮ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। জনসংখ্যার এই হিসেবে বাংলা ভাষা বর্তমান বিশ্বের ৪র্থ বা ৬ষ্ঠ বৃহত্তম জনগোষ্ঠির ভাষা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। অদুর ভবিষ্যতে উন্নত বিশ্বের মর্যাদা পাবে। এসব আমাদের অর্জন। এসব অর্জনকে ধরে রেখে বিশ্বে মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে আমাদের ভাষাকে সঠিক ও শুদ্ধভাবে বিশ্ব সভায় উপস্থাপন করতে হবে।

ভাষা হচ্ছে নদীর স্রোতের মত বহমান। পৃথিবীর যেকোনো ভাষা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। আমাদের বাংলা ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের ভাষা আর আজকের আধুনিক কবিতার ভাষার মধ্যে যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে তা অত্যন্ত স্পষ্ট।

ভাষা সমাজের দান এবং সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে ভাষার পরিবর্তন হয়। তাই সামাজিক শৃঙ্খলার মতো ভাষার শৃঙ্খলা ও বজায় রাখা প্রয়োজন। তা না হলে বিশৃঙ্খলা আর বিভ্রান্তির ব্যাপকতায় একটি ভাষার অধঃপতন অনিবার্য। তুলনামূলক ভাবে বাংলা ভাষার যে জায়গায় সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলা কিংবা অরাজকতা বিরাজমান তা হলো বাংলা বানান। বানান হলো ভাষার একটি প্রায়োগিক দিক। ভাষার চেহারা নির্ভর করে বানানের উপর। বাংলা বানানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ বা সরলীকরণের প্রচেষ্টা দীর্ঘদিনের হলেও ভাষার এই জায়গায় বিশৃঙ্খলার অবসান হয়নি। অনেকটা অজ্ঞতায় এবং অনেকটা অহমিকায় বাঙালির লেখ্য ভাষায় বানান ভুলের সংখ্যা সত্যি লজ্জাজনক। আজকাল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বানান ভুল করা যেন এক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। শুধু ছাত্র-ছাত্রী কেন ? প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, তথা বাংলা ভাষার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেরই সর্বশেষ বানান রীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই। টেলিভিশনের মতো প্রভাবশালী গণমাধ্যম এবং প্রখ্যাত সাহিত্য সংগঠনের কার্যক্রমে প্রমিত বানান রীতি অনুসরণ না করা খুবই দুঃখ জনক। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে সকলের শুদ্ধ ও সর্বশেষ বানানরীতি সম্পর্কে ধারণা থাকা একান্ত প্রয়োজন।

প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলা বানানের কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। সর্বপ্রথম ১৯২৫ সালে বিশ^ ভারতীর উদ্যোগে বানানের জন্য একটি নিয়ম গৃহীত হয়। তারপর ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় প্রায় সর্বজন গ্রাহ্য একটি বানান রীতি চালু করেন। পাকিস্তান আমলে ১৯৪৯ সালের ৯ মার্চ তদানীন্তন পূর্ববাংলা সরকারের উদ্যোগে বাংলাভাষা সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। উক্ত কমিটির রির্পোট ব্যাপক সমালোচিত ও প্রত্যাখাত হয়। তারপর ১৯৬৩ সালে বাংলা বানান সংস্কারের উদ্দেশ্যে আরেকটি কমিটি গঠিত হয়। উক্ত কমিটির রির্পোট ও গৃহীত হয় নি। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানের সমতা বিধানের জন্য ১৯৮৪ সালে একটি কমিটি গঠন করে। উক্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ি ১৯৯২ সাল থেকে পাঠ্যপুস্তক রচিত হতে থাকে। ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে বাংলা একাডেমি সর্বক্ষেত্রে একই বানানরীতি প্রচলনের লক্ষে একটি উদ্যেগ নেয়। এই উদ্যেগের ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ সর্বশেষ পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বর্তমানে বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ ই হচ্ছে বাংলা বানানের সর্বশেষ মানদন্ড।

বাংলা একাডেমি প্রণীত প্রমিত বাংলা বানানে বহুক্ষেত্রে সংস্কার করা স্বত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরো সংস্কার প্রয়োজন বলে অনুভ‚ত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার একটি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১৮ সালে কয়েকটি জেলার বাংলা ও ইংরেজি বানান ও উচ্চারণে সংস্কার সাধন করেছেন। ইতোপূর্বে সেনা শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ঢাকা বানানের ইংরেজি রুপে সংস্কার সাধন করেন। আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি বলে মনে হয়। যেমন-বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলার ‘ঠাকুর’ ইংরেজিতে ‘টেগর’ হয়ে যান। বৃটিশরা উচ্চারণ করতে পারত না বলে ঠাকুরকে- টেগর, চট্টোপাধ্যায়কে- চ্যাটার্জি, বন্দ্যোপাধ্যায়কে- ব্যানার্জি, পালকে- পাউল উচ্চারণ করত। বৃটিশ চলে গেছে সেই ১৯৪৭ সালে। তারপর ১৯৫২ সালে আমরা জীবন দিয়ে মায়ের ভাষাকে রক্ষা করছি। কোন যুক্তিতে বৃটিশদের ভুল উচ্চারণ আমরা এখনো স্বগৌরবে বহণ করছি ? জেলার নামের বৃটিশ প্রদত্ত বানানের সংস্কার করা হলে মানুষের নামের ক্ষেত্রে কেন নয় ? এই উপমহাদেশে বাঙ্গালি মুসলমান পুরুষের নামের পূর্বে মোহাম্মদ এবং মহিলাদের নামের পূর্বে মোছাম্মত শব্দটি যেন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ‘মোহাম্মদ’ শব্দটি একাধিক রুপে লেখা হয়ে থাকে। যেমন- মোহাম্মদ, মোহাম্মেদ, মুহাম্মদ, মহম্মদ, মোঃ, মো., মুহা., মু ইত্যাদি। এর একই রুপ কি কাম্য নয় ? আর মেয়েদের নামের পূর্বে ‘মোছাম্মত’ সম্পূর্ন ভুল প্রয়োগ।

তেমনিভাবে আল্লাহর গুণবাচক নামের ক্ষেত্রে একই বানানরীতি থাকা বাঞ্চনীয় বলে মনে হয়। যেহেতু আমরা বাঙ্গালি মুসলমান সেহেতু আমাদেরকে আরবি বা ইসলাম ধর্মীয় উৎস থেকে আগত শব্দগুলোর প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি, অন্যতায় অর্থের পার্থক্য হওয়া স্বাভাবিক, যা কোন মুসলমানের কাম্য নয়।

লেখক ও কলামিষ্ট

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে ৬০৮ বার

Share Button

Callender

April 2024
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930